পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী আছে, যারা প্রজননের ঠিক পরেই মৃত্যুবরণ করে। এদের জীবন যেন শুধুই একটি লক্ষ্য ঘিরে—নিজের জিনের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা। ভালোবাসা, আকর্ষণ, কামনা কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি গভীর টান—এই সবকিছুর চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা যায় প্রকৃতির সেই নিঃশর্ত নাটকে, যেখানে জীবন দিয়ে হলেও রেখে যেতে হয় একটি উত্তরাধিকার।

এমন কিছু প্রজাতির কথা আজ জানব, যারা মৃত্যুর মুখে হেসে সহবাস করে, যেন ভালোবাসার সবচেয়ে নির্লোভ সংজ্ঞা আমরাই ভুলে গেছি।

১. অস্ট্রেলিয়ান ব্রাউন উইডো স্পাইডার

পুরুষ ব্রাউন উইডো স্পাইডার প্রজননের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের শরীর স্ত্রী মাকড়সার মুখের কাছে রেখে দেয়। প্রজনন শেষ হতেই স্ত্রীটি তাকে খেয়ে ফেলে। এটা এক ধরনের "সেক্সুয়াল ক্যানিবালিজম"। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এই আত্মবলি আসলে ভবিষ্যৎ সন্তানদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায়। নিজেকে উৎসর্গ করার মধ্যে দিয়ে যেন পুরুষটি তার জিনকে ভবিষ্যতের জন্য অমর করে তোলে।

২. প্যাসিফিক সালমন

প্যাসিফিক সালমন মাছদের জীবনচক্র এমন যে, তারা একবারই প্রজনন করে—তাও মৃত্যুর ঠিক আগে। জন্মের পর সমুদ্রে অনেক বছর কাটায়, তারপর হাজার কিলোমিটার upstream সাঁতরে নিজের জন্মস্থানে ফিরে আসে। সেখানে ডিম দেয়ার পর শরীর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায়, হরমোন নিঃশেষ হয়ে যায়, এবং তারা ধীরে ধীরে মারা যায়। এটি এক প্রকার "semelparity", অর্থাৎ একবার প্রজনন করেই মৃত্যু।

৩. অস্ট্রেলিয়ান মার্সুপিয়াল মাউস (Antechinus)

এই ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীটির পুরুষ সদস্যরা প্রজননের সময় এতটাই হরমোনাল উন্মত্ততায় চলে যায় যে, ১৪ দিনের ভেতরে তারা ধ্বংস হয়ে যায়। ইনটেন্স সহবাসের সময় তাদের দেহে কর্টিসল মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়ে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে একে বিকল হতে শুরু করে। তবুও তারা থেমে থাকে না। কারণ একটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ—প্রজন্ম সৃষ্টি।

৪. মে ফ্লাই (Mayfly)

মে ফ্লাই-এর প্রাপ্তবয়স্ক জীবন থাকে মাত্র ২৪ ঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যে তাদের মূল কাজই হলো প্রজনন। কিছু প্রজাতি আবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সহবাস করে মারা যায়। এদের মুখও বিকশিত হয় না—মানে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হল প্রজন্ম রেখে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া বা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা নয়।

৫. অক্টোপাস

মা অক্টোপাস ডিম দেয়ার পর নিজের শরীরের সব শক্তি দিয়ে সেগুলো রক্ষা করে। খাবার না খেয়ে, নড়াচড়া না করে সে শুধু ডিমগুলোর যত্ন নেয়। কিছু সপ্তাহ বা মাসের মধ্যেই সে ক্ষুধায় মারা যায়। পুরুষ অক্টোপাসও প্রজননের পর কিছুদিনের মধ্যে মারা যায়। ভালোবাসার এই গভীর নিঃশব্দ আত্মত্যাগ সত্যিই হৃদয়ছোঁয়া।

ভালোবাসার নিঃস্বার্থ রূপ

এই প্রাণীগুলোর জীবনে প্রেম মানে শুধু শারীরিক সম্পর্ক নয়, বরং এক নিঃস্বার্থ আত্মবলি। মানুষ যেখানে দীর্ঘদিন ভালোবাসা, সম্পর্ক আর প্রজন্মের চিন্তা করে বাঁচে, সেখানে এই প্রাণীরা জন্ম থেকে জানে—তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো প্রজননের মাধ্যমে উত্তরাধিকার রেখে যাওয়া। হয়তো একে আমরা ত্যাগ, ভালোবাসা, বা জেনেটিক কর্তব্য—যেভাবেই বলি না কেন, তারা প্রকৃতির এক মহাকাব্যিক চরিত্র।

প্রকৃতি আমাদের শেখায়—ভালোবাসা মানে শুধু বাঁচা নয়, প্রয়োজনে নিঃশর্তভাবে মরে যাওয়াও।

Post a Comment

Previous Post Next Post