মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর ও বিধ্বংসী আবিষ্কারগুলোর একটি হলো পারমাণবিক অস্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যখন হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে, তখনই বিশ্ব পরিচিত হয়েছে শক্তির এই বিধ্বংসী রূপের সাথে। এরপর থেকেই বিভিন্ন দেশ নিজস্ব নিরাপত্তা ও কৌশলগত উদ্দেশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি শুরু করে। তবে এই শক্তির পেছনে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ মানবিক ও পরিবেশগত ক্ষতির ইতিহাস।
পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র বলতে আসলে কি বুঝি?
পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র বলতে বোঝায় সেই দেশগুলোকে যারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, সংরক্ষণ ও প্রয়োগ করার সক্ষমতা রাখে। বর্তমানে বিশ্বের মোট ৯টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী।
পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ – দুই শ্রেণিতে বিভক্ত
১। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পারমাণবিক শক্তিধর দেশ (NPT স্বাক্ষরকারী ও স্থায়ী শক্তি):
দেশ | পরীক্ষার সংখ্যা | প্রথম পরীক্ষা | সর্বশেষ পরীক্ষা |
---|
যুক্তরাষ্ট্র | ১,০৩২ | ১৬ জুলাই ১৯৪৫ (ট্রিনিটি) | ১৯৯২ |
রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) | ৭১৫ | ১৯৪৯ | ১৯৯০ |
ফ্রান্স | ২১০ | ১৯৬০ | ১৯৯৬ |
যুক্তরাজ্য | ৪৫ | ১৯৫২ | ১৯৯১ |
চীন | ৪৫ | ১৯৬৪ | ১৯৯৬ |
২। স্বীকৃত নয়, তবে বাস্তবে পারমাণবিক অস্ত্রধারী:
দেশ | পরীক্ষার সংখ্যা | প্রথম পরীক্ষা | সর্বশেষ পরীক্ষা |
---|
ভারত | ৬ | ১৯৭৪ | ১৯৯৮ |
পাকিস্তান | ৬ | ১৯৯৮ | ১৯৯৮ |
উত্তর কোরিয়া | ৬ | ২০০৬ | ২০১৭ |
ইসরায়েল | আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি | গোপন | |
নোট:
- ইরান: পারমাণবিক কর্মসূচি থাকলেও অস্ত্র তৈরি করেনি। আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নজরদারির অধীনে রয়েছে।
- তুরস্ক: নিজস্ব অস্ত্র নেই, তবে NATO সদস্য হিসেবে মার্কিন অস্ত্র সম্ভাব্য ঘাঁটিতে থাকতে পারে।
পারমাণবিক পরীক্ষার স্থান, ক্ষতি ও বর্তমান অবস্থা
সেমিপালাটিনস্ক, কাজাখস্তান (সোভিয়েত ইউনিয়ন)
- ১৯৪৯–১৯৮৯ পর্যন্ত ৪৫৬টি পরীক্ষা চালানো হয়।
- প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত।
- বহু শিশু জন্মগত ত্রুটিতে ভুগছে, ক্যান্সার ও মানসিক সমস্যার হার অনেক বেশি।
- বর্তমানে “The Polygon” নামে পরিচিত, পরিত্যক্ত ও বিপজ্জনক এলাকা।
ট্রিনিটি সাইট, নিউ মেক্সিকো
- ১৬ জুলাই ১৯৪৫ সালে প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে।
- পার্শ্ববর্তী জনপদে রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ে। বহু মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
- এখনও রেডিয়েশন স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ গুণ বেশি।
- পর্যটকদের জন্য বছরে দুবার খোলা হয়।
সাহারা মরুভূমি, আলজেরিয়া (ফ্রান্স)
- ১৯৬০–৬৬ সালে ফ্রান্স এখানে ১৭টি পরীক্ষা চালায়।
- স্থানীয় জনগণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এখনো বহু স্থানে তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে।
মোন্টে বেলো দ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া (যুক্তরাজ্য)
- ১৯৫২ সালে ‘অপারেশন হারিকেন’ নামে পরীক্ষা চালানো হয়।
- সমুদ্রজীব এবং স্থানীয় ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হয়।
পোখরান, ভারত
- ১৯৭৪ (“Smiling Buddha”) ও ১৯৯৮ (“Operation Shakti”)—দুটি ধাপে ৬টি পরীক্ষা করা হয়।
- পরীক্ষার সময় অঞ্চলগুলোতে ভূমিকম্পের মতো কম্পন হয়।
- বর্তমান পরিস্থিতি সামরিক নিয়ন্ত্রিত, গবেষণার আওতায়।
চাগাই, পাকিস্তান
- ২৮ মে ১৯৯৮ - চাগাই পাহাড়ে ৫টি বিস্ফোরণ চালানো হয়।
- বিস্ফোরণের প্রভাব পার্বত্য অঞ্চলে সীমিত হলেও পরিবেশগত উদ্বেগ ছিল।
পাংগে-রি, উত্তর কোরিয়া
- ২০০৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৬টি বিস্ফোরণ ঘটে।
- ২০১৭ সালের পরীক্ষায় পার্বত্য অঞ্চলে ধস নামে, পার্শ্ববর্তী চীন পর্যন্ত কম্পন হয়।
- কিছু টানেল ধ্বংস করা হলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ নেই।
ক্ষতির রূপরেখা
- মানবিক ক্ষতি: জন্মগত ত্রুটি, ক্যান্সার, দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যা।
- পরিবেশগত ক্ষতি: পানি, মাটি, উদ্ভিদ, পশু—সবই রেডিয়েশনের শিকার।
- আর্থসামাজিক প্রভাব: ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবনতি।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উদ্যোগ
- সেমিপালাটিনস্ক অঞ্চলে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প চালু করা হয়েছে।
- ট্রিনিটি সাইটে পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য।
- অধিকাংশ দেশ “Comprehensive Nuclear-Test-Ban Treaty (CTBT)” চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, যদিও এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
- উত্তর কোরিয়া ছাড়া বর্তমানে কেউ পারমাণবিক পরীক্ষা চালাচ্ছে না।
২০২৫ সালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ৯টি দেশের আনুমানিক পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা দেওয়া হলো (উৎস: SIPRI, FAS, Arms Control Association):
প্রমাণিত পারমাণবিক শক্তিধর দেশসমূহ (NPT অনুযায়ী)
দেশ | মোট অস্ত্র (আনুমানিক) | প্রস্তুত অবস্থায় | মন্তব্য |
---|
রাশিয়া | ৫,৫৮০+ | ১,৭১০+ | বিশ্বের সবচেয়ে বেশি |
যুক্তরাষ্ট্র | ৫,০৪৪+ | ১,৭৪০+ | ব্যাপক সংখ্যক অস্ত্র প্রস্তুত |
চীন | ৫১০+ | কিছু প্রস্তুত | দ্রুত আধুনিকায়ন চলছে |
ফ্রান্স | ২৯০ | ৮০+ | শুধুমাত্র সমুদ্র ও বিমান ভিত্তিক |
যুক্তরাজ্য | ২২৫ | ১২০+ | ন্যূনতম প্রতিরোধ নীতিতে অনুযায়ী |
NPT বহির্ভূত পারমাণবিক শক্তিধর দেশসমূহ
দেশ | মোট অস্ত্র (আনুমানিক) | প্রস্তুত অবস্থায় | মন্তব্য |
---|
ভারত | ১৭৬ | খুব কম | সীমিত রেঞ্জের অস্ত্র |
পাকিস্তান | ১৭০ | কিছু প্রস্তুত | চীন-ভারতের ভারসাম্য রাখতে প্রস্তুত করা হয়েছে |
ইসরায়েল | ৯০ (আনুমানিক) | গোপনে | অফিসিয়ালি স্বীকার করে না |
উত্তর কোরিয়া | ৫০+ (আনুমানিক) | অজানা | বারবার পরীক্ষা চালিয়েছে |
মোট হিসাব (২০২৫):
- মোট পারমাণবিক অস্ত্র (সব মিলিয়ে): প্রায় ১২,১০০টির মতো।
- এর মধ্যে ৩,৯০০টির বেশি অস্ত্র “অপারেশনাল” বা প্রস্তুত” অবস্থায় আছে।
পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্বে একটি বিশাল নিরাপত্তা ও নৈতিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যদিও অনেক দেশ পারমাণবিক শক্তিকে আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসেবে দেখে, ইতিহাস প্রমাণ করে এটি মানবজাতির অস্তিত্বের জন্যই হুমকি।
আপনার মতামত দিন!
আপনার কি মনে হয়, পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্ব শান্তি রক্ষার উপায়, নাকি মানব ধ্বংসের চাবিকাঠি?
নিচে কমেন্ট করুন ও এই তথ্য শেয়ার করে অন্যদের সচেতন করুন।
Post a Comment