ইন্টারনেট — এক আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ!
একদিকে অগণিত তথ্যের ভাণ্ডার, অপরদিকে এক নিরব ঘূর্ণি যা প্রতিনিয়ত আমাদের মানসিক ও সামাজিক কাঠামোকে ভাঙচুর করছে। আঁচল ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক জরিপের চিত্র আরও একবার সেই বাস্তবতাকে সামনে এনেছে: ৯১% শিক্ষার্থী ইন্টারনেট ব্যবহারকে "আসক্তি" হিসেবে অনুভব করছে!

এটা নিছক একটি পরিসংখ্যান নয়। এটা হলো একটি প্রজন্মের আত্মঘাতী যাত্রাপথের প্রতিফলন।

ইন্টারনেট আসক্তি: মিশ্র বাস্তবতা না আতঙ্ক?

আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৮৫.৯ শতাংশ ইন্টারনেটকে দায়ী করেছে তাদের মানসিক সমস্যার জন্য। এদের মধ্যে কেউ বিষণ্ণতায় ভুগছে, কেউ নিঃসঙ্গতায়, আবার কেউ বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভার্চুয়াল জগতে বাস করছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদের মতে, “আমাদের তরুণদের সময় কাটানোর কোনো স্বাস্থ্যকর মাধ্যম নেই—না আছে খেলার মাঠ, না পারিবারিক বিনোদন। ফলে তারা অবলম্বন করছে ইন্টারনেটকে, যা একসময় রূপ নিচ্ছে আসক্তিতে।”

কিন্তু এই জরিপ কি পুরোপুরি বাস্তবতার প্রতিফলন?
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলছেন, “এই জরিপ স্বতঃস্ফূর্ত মতামতের ভিত্তিতে। অনেকে নিজেই মনে করছে সে আসক্ত, বাস্তবে হয়তো তা নয়। তবে এর মানে এই নয় যে সমস্যা নেই। বরং এই ধোঁয়াশাই আমাদের জন্য বড় হুমকি।”

আসক্তির বীজ: কৌশলে বোনা ডিজিটাল ফাঁদ

বিশ্লেষক জাকারিয়া স্বপন একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ সামনে আনেন — ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রোডাক্টগুলোর মূল লক্ষ্যই হলো “আসক্ত করা”
ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক—সবচেয়ে জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোর ব্যবসা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের “স্ক্রিন টাইম”-এর ওপর।

তাদের কাছে আমরা কেবল ব্যবহারকারী নই, বরং “ডেটা” আর “ধরার মাছ”।
তারা আমাদের চাওয়া-পাওয়া, অভ্যাস, সময়—all hack করে দেয় এক নিখুঁত অ্যালগরিদমে, যাতে আমরা আরও কিছুক্ষণ স্ক্রল করি, আরও এক ক্লিক দিই।

শিক্ষার্থীদের হারিয়ে যাওয়া পথ

জরিপ বলছে,

  • ৫৯.৬% শিক্ষার্থী মনে করে ইন্টারনেটে সময় নষ্ট পড়াশোনার ক্ষতি করছে।
  • ৫২.৬% শিক্ষার্থীর মনোযোগ হারায় পড়াশোনায়।
  • ৩৫.৬% শিক্ষার্থী ডিপ্রেশনে ভোগে।
  • ২৩.৬% নিজেদের দুটি জীবনের মধ্যে বিভক্ত মনে করে — একটি বাস্তব, অন্যটি ভার্চুয়াল।

এই বিচ্ছিন্নতা ভয়াবহ। ভার্চুয়াল জীবনের ফিল্টার করা সুখ আর গ্ল্যামার বাস্তব জীবনের জটিলতা, দায়-দায়িত্ব, পরিশ্রমকে অচেনা করে তুলছে। ফলে বাস্তবতা তাদের কাছে হয়ে উঠছে বিষাদময়।

সচেতনতার আলো: ইন্টারনেট লিটারেসি ও পারিবারিক দায়িত্ব

ইন্টারনেট এখন জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাই এটা “বন্ধ” করার কথা বললে সেটা বাস্তবতা নয়, বরং পালানোর কৌশল। দরকার হলো "ইন্টারনেট লিটারেসি" — কীভাবে, কতটা, কিসে সময় দেব?

এটা শেখানো দরকার পরিবারে, স্কুলে, সমাজে।
যদি বাবা-মারাই সারাদিন ফেসবুকে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সন্তান কী শিখবে?
“তারা তো দেখে শিখে”—এটাই সবচেয়ে বড় সত্য।

সমাধান কী?

  • কাউন্সেলিং: যারা আসক্ত, তাদের জন্য মানসিক সহায়তা ও থেরাপি প্রয়োজন।
  • আন্তঃপ্রজন্ম যোগাযোগ: বাবা-মা ও সন্তানের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা দরকার—ইন্টারনেটের সুবিধা ও ঝুঁকি দুটো নিয়েই।
  • নিয়মিত অফলাইন সময়: পরিবারে নিয়ম করে অফস্ক্রিন টাইম রাখা।
  • ডিজিটাল ডিটক্স ক্যাম্পেইন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম।
  • বিকল্প বিনোদন: খেলার মাঠ, লাইভ ক্লাব, বুক ক্লাব, মিউজিক স্কুল—যেখানে তরুণরা ভার্চুয়াল না থেকে বাস্তব সংযোগ গড়তে পারে।

শেষ কথা

ইন্টারনেট দানব নয়—এটা একটা টুল। কিন্তু সেই টুলকে হাতে নেওয়ার আগে দরকার জ্ঞান, সংযম আর দায়িত্ব।
বর্তমান প্রজন্ম যদি এই ভারসাম্য রক্ষা না করতে পারে, তাহলে আগামী প্রজন্ম এক ভয়ংকর, নিঃসঙ্গ, ভার্চুয়াল কল্পনাজগতে হারিয়ে যাবে—যেখানে বাস্তবতা ধোঁয়াশায় পরিণত হবে।

তাই এখনই সময় প্রযুক্তির গ্যাড়াকল থেকে বেরিয়ে এসে মানবিক, স্বাস্থ্যকর, ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের দিকে ফিরে যাওয়ার।


উৎস: DW বাংলা ও অন্যান্য বিশ্লেষণভিত্তিক তথ্য

Post a Comment

Previous Post Next Post