“সিন্ডিকেট”—শব্দটা শুনলেই আমরা সাধারণত কিছু গোপন চুক্তি, লুকানো শক্তি আর বাজার বা সমাজের উপর একক নিয়ন্ত্রণের কথা বুঝি। বাস্তবে এটি শুধু ব্যবসায় বা অর্থনীতিতে নয়, আমাদের শিক্ষা, রাজনীতি, পেশা, এমনকি নীতির ক্ষেত্রেও প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে। এই ব্লগে আমরা জানবো: সিন্ডিকেট কী, কিভাবে এটা কাজ করে, কোথায় কোথায় বিস্তার ঘটায়, আর আমাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলে।

সিন্ডিকেট কী?

"সিন্ডিকেট" শব্দটি এসেছে ফরাসি "syndicat" থেকে, যার অর্থ কোনো যৌথ সংগঠন বা সমিতি। তবে আমাদের দেশীয় বাস্তবতায় এটি অর্থ নেয় একটি গোষ্ঠী—যারা নিজেদের স্বার্থে এক হয়ে অন্যদের প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত করে।

সহজ ভাষায়:

একটি গোপন শক্তি যেখানে কিছু মানুষ একত্র হয়ে, ন্যায্য প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে, নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য নিয়ম ভাঙে বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে—সেটাই সিন্ডিকেট। বা, আমাদের চারপাশে একটা অদৃশ্য শিকল যেন সব সময় পা আটকে রাখে—চাকরি, শিক্ষা, ব্যবসা, বাজার, চিকিৎসা—যেদিকেই তাকাই, দেখি একেকটা গোষ্ঠী বা চক্র নিজেদের সুবিধার্থে বাকি সবাইকে বঞ্চিত করছে। এই গোষ্ঠীবদ্ধ অনৈতিক শক্তিকেই আমরা বলি "সিন্ডিকেট"

১. পণ্যবাজারে সিন্ডিকেট

প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস—চাল, পেঁয়াজ, ডিম, তেল ইত্যাদির দামে হঠাৎ হঠাৎ আগুন লাগে। আপনি ভাবেন "বন্যা", "জ্বালানি সংকট" ইত্যাদি, কিন্তু এর পেছনে প্রায়ই থাকে একদল বড় ব্যবসায়ীর সিন্ডিকেট—যারা পণ্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে।

২. শিক্ষাক্ষেত্রে সিন্ডিকেট

বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, ফলাফল নির্ধারণ, এমনকি শিক্ষক নিয়োগেও দেখা যায় এক ধরনের সিন্ডিকেট। যোগ্যতা নয়, পরিচয় বা প্রভাব হয়ে দাঁড়ায় সিদ্ধান্তের মূল মানদণ্ড।

৩. চাকরির ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট

সরকারি/বেসরকারি চাকরিতে অনেক সময় দেখা যায় “ভাইভা বোর্ড” আগেই নির্ধারিত। মেধাবী নয়, সিন্ডিকেটে থাকা ‘সুপারিশপ্রাপ্ত’ প্রার্থীই নিয়োগ পায়।

৪. পরিবহন খাতে সিন্ডিকেট

একটি রুটে কয়টি বাস চলবে, কোন পরিবহন মালিক কত আয় করবে—সবই নিয়ন্ত্রণ করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। একদল শ্রমিক নেতা আর মালিক এই খেলায় সাধারণ যাত্রী শুধু “ভুক্তভোগী”।

কেন এটা বিপজ্জনক?

  • যোগ্যতার বদলে পরিচয় বড় হয়ে দাঁড়ায়
  • মেধাবী, সৎ মানুষের মনোবল ভেঙে পড়ে
  • জনগণের প্রতি অন্যায় হয় কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করতে পারে না
  • দুর্নীতি একটা “নতুন নিয়ম” হয়ে দাঁড়ায়

এখন বুঝতে হবে—কেন সিন্ডিকেট টিকে থাকে?

  • সিন্ডিকেট কোনো একদিনে গড়ে ওঠে না। এটি গড়ে ওঠে:
  • যখন মানুষ নিজের ক্ষতির চেয়ে ছোট সুবিধাকে বড় মনে করে
  • যখন আমরা প্রশ্ন করতে ভয় পাই
  • যখন আমরা একা থাকি, সংঘবদ্ধ হই না
  • যখন নীতি-নৈতিকতা নেমে আসে কাগজে কলমে
  • যখন যোগ্যতা নয়, পরিচয় হয় মূল মাপকাঠি

তাহলে মুক্তির উপায় কী?

সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে প্রথমে ভাঙতে হবে নীরবতা

সিন্ডিকেট কখনোই একদিনে তৈরি হয় না। এটি জন্মায় যখন আমরা ন্যায়ের বদলে সুবিধা খুঁজি, যখন আমরা প্রশ্ন না করে মানিয়ে নেই। তাই পরিবর্তনের শুরু হতে পারে প্রশ্ন থেকে, প্রতিবাদ থেকে, বিকল্প তৈরি থেকে।

একটি সমাজ, একটি দেশ, কখনই এগোতে পারে না যেখানে অদৃশ্য শক্তি মেধাকে গলা টিপে মারে।

১. স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

  • সরকারি নিয়োগ, ভর্তি, দরপত্র, প্রমোশন—সব কিছুতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।
  • সবার জন্য উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার থাকতে হবে: কারা নিয়োগ পেল, কিভাবে পেল, কার রেফারেন্সে পেল—সবকিছু প্রকাশ্য হোক।

২. প্রশ্ন করতে শিখতে হবে

  • “সবাই এমন করে” এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
  • অন্যায় দেখলে চুপ থাকা নয়, কণ্ঠ তুলতে হবে—সামাজিকভাবে, ডিজিটালি, আইনি পথে।

৩. সচেতন নাগরিক জোট গঠন

  • একা কিছুই হয় না। একাধিক সচেতন মানুষ একত্র হয়ে জোট গড়লে যে কোনো সিন্ডিকেট দুর্বল হয়।
  • শিক্ষার্থী, তরুণ, মিডিয়া ও পেশাজীবীদের জোট হতে পারে বড় শক্তি।

৪. বিকল্প তৈরি করতে হবে

  • যদি একটা চাকরিতে সিন্ডিকেট থাকে, তাহলে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে মেধা-যোগ্যতা মূল্য পায়।
  • উদাহরণ: অনলাইন মার্কেটপ্লেস, স্টার্টআপ, কমিউনিটি-চালিত উদ্যোগ।

৫. নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে নৈতিকতা ও সচেতনতায়

  • পরিবার, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈতিকতা, নেতৃত্ব, স্বচ্ছতার শিক্ষা দিতে হবে।
  • শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য নয়, সমাজ গড়ার জন্য তৈরি করতে হবে নতুন মানুষ।

প্রতিরোধ না করলে পরিবর্তন আসবে না 

সিন্ডিকেট কখনোই আপনাকে সুযোগ দেবে না; আপনাকেই সেটা ভাঙতে হবে। প্রশ্ন, প্রতিবাদ, বিকল্প এবং দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে যদি সবাই এগিয়ে আসে, তাহলে এই অদৃশ্য শিকল একদিন ঠিকই ভেঙে যাবে।

"সংঘবদ্ধ অন্যায়ের চেয়ে একটি সত্য অনেক শক্তিশালী, যদি আমরা তাকে বিশ্বাস করতে শিখি।"


Post a Comment

Previous Post Next Post